ভুমিকাঃ
বাংলাদেশের জাতীয় ফল আম। দেশের প্রায় সব জেলাতেই আম উৎপাদিত হয়। চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, যশোর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও পার্বত্য জেলাগুলোতে বেশীরভাগ আম উৎপন্ন হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রায় ২৭ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে (সূত্র-ডিএই)
জলবায়ু এবং মাটিঃ
আম প্রধানত উষ্ম মন্ডলের ফল। আম উৎপাদনের জন্য ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযোগী। যে কোন ধরনের মাটিতেই আমের চাষ করা যায় তবে গভীর, সুনিস্কাশিত, উর্বর দোঁ-আশ মাটি আম চাষের জন্য উত্তম। আম চাষের জন্য মাটির পিএইচ ৫.৫-৭.৫ সর্বোত্তম।
জাতঃ
বাংলাদেশে উৎপাদিত আম গুলোকে সাধারনত গুটির আম (Seedling mangoes) এবং (Grafted Mangoes) এ দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। গুটির আম সাধারনত নিম্নমানের এবং এ গুলোতে অনেক বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কলমের আম জাত অনুযায়ী একই গুণ, মান, আকার ও আকৃতির হয়ে থাকে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনষ্টিটিউট থেকে এ পর্যন্ত বারি আম-১ থেকে বারি আম-১৮ নামে মোট ১৮ টি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশী কিছু আমের জাত বর্তমানে খুব জনপ্রিয়। এরমধ্যে রয়েছে ব্যানানা ম্যাংগো, কাটিমন, আলফানসো, সূর্যডিম, ব্রুনাই কিং, পালমার, থাই-৭, কেপি, চিয়াংমাই, চাকাপাত, কিউজাই, তাইওয়ান গ্রিন, তাইওয়ান রেড, থাই রেড ইত্যাদি। দেশি জাতের মধ্যে রয়েছে ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলী, গোপালভোগ, খিরসাপাত, গৌড়মতি, সূর্যপুরী, হাড়িভাঙ্গা, আশ্বিনা, নাগফজলী ইত্যাদি। পাকার সময় অনুসারে আমের জাত সমূহকে আগাম, মধ্য মৌসুমী ও নাবি এ তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে।
আগাম জাত সমূহঃ
যে জাত সমূহ মধ্য মে হতে মধ্য জুন মাসের মধ্যে পাকে সেগুলো আগাম জাতের অন্তর্ভূক্ত। এসবের মধ্যে গোপালভোগ, খিরসাপাত, বৃন্দাবনী ও বারি আম-১ (মহানন্দা) উল্লেখযোগ্য।
মধ্য মৌসুমী জাত সমূহঃ
যে জাত সমূহ মধ্য জুন হতে জুন মাসের শেষ দিকে পাকে সেগুলো মধ্য মৌসুমী জাতের অন্তর্ভূক্ত। এসবের মধ্যে ল্যাংড়া, কিষানভোগ, কোহিতুর, হিমসাগর, সূর্যাপুরী, বারি আম-২ (লক্ষণভোগ) ও বারি আম-৩ (আম্রপালী), হাড়িভাঙ্গা ইত্যাদি।
নাবী জাত সমূহঃ
যে জাত সমূহ জুলাই হতে আগষ্ট মাসের মাঝামাঝির দিকে পাকে সেগুলো নাবী জাতের অন্তর্ভূক্ত। এগুলোর মধ্যে ফজলী, আশ্বিনা, গৌড়মতি, কাটিমন, মোহনভোগ ও কুয়াপাহাড়ী উল্লেখযোগ্য। গৌড়মতি ও কাটিমন জাত সবচেয়ে শেষে পাকে।
মাতৃগাছ নির্বাচন এবং সায়ন সংগ্রহ
কলমের সাহায্যে কাঙ্খিত গাছ উৎপাদনের জন্য মাতৃগাছ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য রোগ বালাই মুক্ত সুস্থ ও সবল এবং যে গাছের আম গুণে ও মানে উন্নত এবং পর্যাপ্ত ফল দেয় এমন কাঙ্খিত মাতৃগাছ থেকে সায়ন সংগ্রহ করা উচিত। ২০-৩০ সে.মি. লম্বা ৩-৪ মাস বয়সের প্রান্ত শাখা সায়নের জন্য উপযুক্ত। সায়নের পাতাগুরো কলম তৈরীর ১০-১৫ দিন আগে বোঁটা রেখে সব কেটে ফেলতে হবে। বোঁটাগুলো আপনা আনি পড়ে গেলে সায়নটি কলম করার জন্য উপযুক্ত হয়। এ সময় সায়নের চোখ গুলো বা সুপ্ত কুঁড়িগুলো বেশ পুষ্ট ও বড় হয়।
গর্ত তৈরী ও চারা রোপন
আমের জাতের উপর ভিত্তি করে সঠিক দূরত্বে চারা রোপন করতে হবে তবে আম গাছ সাধারণত ১০-১২ মি. দূরত্বে রোপন করা হয়। খাটো জাতের গাছ গুলো যেমন- আম্রপালি ৫x৫ মি. দূরত্বে রোপন করা যেতে পারে। চার রোপনের জায়গা খুটি দিয়ে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। পরে খুঁটি তুলে সেই জায়গায় প্রায় ৭৫ সে.মি. দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীর করে গর্ত করতে হবে। গর্ত তৈরীর সময় উপরের অংশের মাটি এক পাশে ও নীচের অংশের মাটি আর এক পাশে রাখতে হবে। গর্ত ভর্তি করার সময় গর্তের উপরের অংশের মাটির সাথে ১০ কেজি গোবর সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে একটি চারা সোজাভাবে লাগিয়ে চারদিকে মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে চারা রোপনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন ক্রমেই গাছের গোড়ার মাটির বলটি ভেঙ্গে না যায় এবং চারা বা কলমের গোড়াটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাটির নিচে ঢুকিয়ে দেয়া না হয়। বাতাসে গাছের গোড়া যাতে না নড়ে যায় সে জন্য চারাটির দু’দিকে দুটি খুটি পুঁতে ভালভাবে রশি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। মে থেকে জুলাই মাসেই চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে সেচের সুবিধা থাকলে মার্চ-এপ্রিল মাসেও চারা রোপণ করা যায়।
সার প্রয়োগ
গাছ রোপণের বছর ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সমান দুই ভাগে ভাগ করে একভাগ এপ্রিল-মে মাসে এবং আরেক ভাগ সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে গাছের গোড়ার চার দিকে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরবর্তী বছর গুলোতে সারের পরিমাণ বয়স অনুসারে বাড়িয়ে দিতে হবে।
অন্তর্বতীকালীন পরিচর্যা
আগাছা দমন
আম গাছের গোড়ায় যাতে কোন আগাছা জন্মাতে না পারে সে জন্য গোড়ার মাটি কুপিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং প্রতি বছর বাগানে লাঙ্গল-এর সাহায্যে বর্ষা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে একবার এবং বর্ষা শেষ হয়ে আসার পর আরেকবার জমিতে চাষ দিলে অতি সহজেই আগাছা দমন করা যায়।
ছাঁটাইকরণ
রোপণের ২-৩ বছর পর্যন্ত গাছের গোড়া থেকে ডালপালা গজালে তা কেটে ফেলতে হবে। গাছের প্রধান কান্ডটি যাতে সোজাভাবে অন্তত ৩ ফিট লম্বা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এই উচ্চতায় গাছের চারপাশে৪-৬ টি শাখা বাড়তে দেয়া যেতে পারে। ভিতরমুখী ডালপালা কেটে ফেলা উচিত। বড় গাছের মরা, রোগাক্রান্ত ডালগুলিও ছেটে দেয়া উচিত।
গাছের মুকুল ভেঙ্গে দেয়াঃ
গাছের বয়স ২-৩ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙ্গে দিতে হবে।
পরগাছা দমনঃ
আমগাছে লোরানথাস নামের পরগাছাটি সচরাচর দেখা যায়। পরগাছাটি আমের ফলনে ব্যপক প্রভাব ফেলে। তাই ফল সংগ্রহের পরপরই পরগাছাগুলো গোড়া থেকে তুলে ফেলতে হবে।